October 18, 2024, 5:31 am

হিজরি নববর্ষের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রেক্ষাপট

হিজরি নববর্ষের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রেক্ষাপট

মোঃ আরিফ হোসেন রনি, সাতক্ষীরা:-
মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য হিজরি সন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বর্ষপঞ্জি হচ্ছে জীবনের একটা অপরিহার্য অংশ। দিন, মাস আর সনের হিসাব ছাড়া আধুনিক পৃথিবীতে কোনো কাজই চলে না। আমাদের বাংলাদেশে তিনটি বর্ষপঞ্জির ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
১.হিজরী, ২.বাংলা ও ৩.ইংরেজি। সরকারি-বেসরকারি দাপ্তরিক কাজকর্ম, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও লেনদেনের ক্ষেত্রে ইংরেজি বর্ষপঞ্জির গুরুত্ব অপরিসীম। হিন্দু-সম্প্রদায়ের পূজা-পার্বণ, বিয়ের দিনক্ষণ নির্ধারণ আর কৃষিজীবীদের আবাদি মৌসুমের হিসাব ছাড়াও বাংলাদেশে বাংলা পঞ্জিকার ব্যবহার হয়ে থাকে। মুসলমানদের নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, শবেবরাত, শবেকদর, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহাসহ ধর্মীয় বিষয়াবলির জন্য হিজরি সনের হিসাব অপরিহার্য।
১লা মহররমের মধ্যদিয়ে হিজরি নববর্ষ শুরু হয়। মুহররম ইসলামী পঞ্জিকা হিজরি সনের প্রথম মাস। মুসলমানদের রোজা, হজ, ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর, শবে মেরাজসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সময়ে ও তার পূর্বে রোমান, পারসিয়ান ও অন্যান্য জাতির মধ্যে তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা প্রচলিত ছিল। আরবদের মধ্যে কোনো নির্ধারিত বর্ষ গণনা পদ্ধতি ছিল না। বিভিন্ন ঘটনার উপর নির্ভর করে তারিখ বলা হত। খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা.) এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনে, প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) ইরাক এবং কুফার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একদা হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) খলিফা উমরের (রা.) খেদমতে এ মর্মে পত্র লিখেন যে, আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশ সংবলিত যেসব চিঠি আমাদের নিকট পৌঁছে তাতে দিন, মাস, কাল, তারিখ ইত্যাদি না থাকায় কোন চিঠি কোন দিনের তা যাচাই করা আমাদের জন্য সম্ভব হয়ে উঠে না । ফলে আপনার নির্দেশ কার্যকর করতে সমস্যা হয়।

হিজরী সনের কোন মাস থেকে দিন গণনা শুরু করবেন তাহার পরামর্শের জন্য সাহাবীদের সাথে আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে হজরত উমর (রা.) বললেন, হুজুর (সা.) এর জন্মের মাস থেকে হিজরি সনের গণনা শুরু করা যাবে না। কারণ খ্রিস্টান সম্প্রদায় হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের মাস থেকেই খ্রিস্টাব্দের গণনা শুরু করেছিল। তাই রাসূলের জন্মের মাস থেকে সূচনা করা হলে বাহ্যত খ্রিস্টানদের অনুসরণ ও সাদৃশ্যতা হয়ে যায়, যা মুসলমানদের জন্য বেমানান।কারণ খ্রিষ্টানদের অনুসরণ ও সাদৃশ্যকরণ করতে রাসূল (সা) নিষেধ করেছেন। অপরদিকে হুজুর (সা.)-এর ওফাত দিবসের মাস থেকেও গণনা শুরু করা যাবে না, কারণ এতে হুজুর (সা.) এর মৃত্যু ব্যাথা আমাদের মাঝে বারবার উত্থিত হবে। হজরত ওমর (রা.)-এর দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্যকে হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.) এক বাক্যে সহমত পোষণ করে বললেন, এরই পরিপ্রেক্ষিতে খলিফা হযরত উমর ফারুক (রা.) হিজরতের বছর থেকেই ইসলামি তারিখ  গণনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ।
হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে হিজরি সনের গণনা শুরু হয়।

মুসলিম জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরী সনের প্রথম মাস হলো মহররম। মহররম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতপূর্ণ মাস। মুসলিম ইতিহাসে এ মাসটি বিভিন্ন কারণে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। এ মাসটিকে ‘শাহরুল্লাহ’ তথা আল্লাহর মাস বলা হয়। এ প্রসঙ্গে নবী সাঃ বিদায় হজ্বের সময় মিনা প্রান্তরে প্রদত্ত খোতবায় বলেন, “চারটি মাস রয়েছে যেগুলো সম্মানিত মাস। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো মহররম। (বুখারী, হা-১৭১২)।”
এ মাসেই রয়েছে ফজিলতপূর্ণ ‘আশুরা’ দিবস। মহররমের দশম তারিখে ঐতিহাসিক ‘কারবালা’ সংঘটিত হয়েছিল। এছাড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই দিনে ঘটেছে। মহররমের ফজিলতপূর্ণ অনেক আমল রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নফল রোজা।
১০ই মহররম ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার জন্যে কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদের বাহিনীর কাছে হযরত হুসাইন’র (রা) সৈন্যসহ স্ব-পরিবারে শহীদ হন।কিন্তু ইয়াজিদের বশ্যতা স্বীকার করে নি বা মেনে নেয় নি।

রমজানের পরে সবচেয়ে বেশি ফযিলতের রোযা হলো আল্লাহর মাস মুহাররামের রোযা। আশুরার রোজা সব নবীর আমলেই ছিল। নবী করিম (সা.) মক্কায় থাকতেও আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসে রাসুলুল্লাহ (সা.) দেখতে পেলেন, ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখছে। প্রিয় নবী (সা.) তাদের রোজার কারণ জানতে চাইলেন, তারপর জানতে পারলেন, এ দিনে মুসা (আ.) সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত লাভ করেন। এ দিনেই তিনি বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কয়েদখানা থেকে উদ্ধার করেন এবং এ দিনেই তিনি বনি ইসরাইলদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। আর ফেরাউন সেই সাগরে ডুবে মারা যায়। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ইহুদিরা এই দিন রোজা রাখে। মহানবী (সা.) বললেন, মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তোমাদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ও অগ্রাধিকারমূলক। অতঃপর তিনি ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ বা ১১ মহররম মিলিয়ে আগের দিন বা পরের দিন দুটি রোজা রাখতে বললেন। কারণ, ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের যেন সাদৃশ্য না হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজান মাসের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল।
“রমজানের রোজার পর আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ। এ মাসের নফল রোজা ও অন্যান্য ইবাদত রমজান মাস ছাড়া অন্য যেকোনো মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম। (মুসলিম ও আবু দাউদ)।”

হিজরি নববর্ষকে গুরুত্বসহকারে পালন করাই ছিল  মুসলিম অধ্যুষিত দেশের জন্য অবশ্য  কাম্য। যেসব উপাদান মুসলিম উম্মাহকে উজ্জীবিত করে তন্মধ্যে হিজরি সন অন্যতম। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-কালচারে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরি সন গণনার সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্ময়রণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে। রাসুল (সা.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীবর্গের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আরবি মহররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস ধরে সাল গণনা শুরু হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে তথা দ্বীনের স্বার্থে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রাসুল (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামগণের হিজরতের বছর থেকেই হিজরি সনের সূচনা। 
হিজরি সনের সম্পর্ক চাঁদের সাথে থাকার কারণে এই সনের তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক। এই চাঁদের হিসাবে মুসলমানদের অনেক ইবাদত-বন্দেগী, আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে। কাজেই সর্বক্ষেত্রে হিজরি তারিখকে গুরুত্ব দেয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য  জরুরি। হিজরি নববর্ষের মাধ্যমে মুসলমান সম্প্রদায় নব উদ্যমে , মানবতা আর ত্যাগের মহান ব্রত নিয়ে ইবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved © 2023 satkhirachitra.com
Design & Developed BY CodesHost Limited